লালবাগ দুর্গ ইতিহাস : এক অসমাপ্ত দুর্গে ভ্রমনের গল্প

শুরুটা রহস্য দিয়ে

অনেকেই বলে ঢাকার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা লালবাগ দুর্গের নিচে নাকি একসময় কিছু সুরঙ্গ ছিল যা দিয়ে সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে পৌঁছানো যেত। এটি এমন একটা দুর্গ, যার নির্মাণ থেমে গিয়েছিল এক কিশোরীর মৃত্যুর জন্য। কিন্তু কেন? কী এমন হয়েছিল যে দুর্গের কাজ থামাতে হলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আজ আমি বের হলাম লালবাগ দুর্গটি ঘুরে দেখতে। আর সেই সাথে চেষ্টা করব আপনাদের এই দুর্গের ইতিহাস আর সৌন্দর্যকে আজ একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরতে।

দুর্গে যাওয়া

লালবাগ দুর্গে আসার অনেক উপায় রয়েছে। তবে আমি শাহবাগ থেকে ৬০ টাকা রিকশাভাড়া করে চলে এলাম দুর্গের সামনে। পুরান ঢাকার আশপাশ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব সহজেই আসা যায় এই দুর্গে।

প্রবেশ মূল্য

দুর্গে ঢুকতে হলে প্রথমেই আপনি যদি বাংলাদেশি হন, আপনার ২০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। আর বিদেশিদের জন্য সেটা ১০০ টাকা।

যদিও বোর্ডে লেখা অনুযায়ী নেওয়া হয় না

লালবাগ দুর্গ: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

লালবাগ দুর্গ, যেটিকে একসময় আওরঙ্গাবাদ দুর্গ নামেও ডাকা হতো, এটি মূলত একটি মুঘল প্রাসাদ দুর্গ। এর অবস্থান পুরান ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। যদিও এখন নদীটা অনেকটা সরে গিয়ে দূরে চলে গেছে, কিন্তু ১৮০৯ সালের ডয়েলীর আঁকা চিত্রে দেখা যায়—এই দুর্গের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ একসময় সরাসরি নদী সংলগ্ন ছিল।

এই দুর্গের নির্মাণ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে, যখন বাংলার সুবাহদার ছিলেন যুবরাজ মুহম্মদ আজম। কিন্তু কাজ শেষ হবার আগেই তাঁকে সম্রাট আওরঙ্গজেব দিল্লিতে ফিরিয়ে নেন। পরবর্তীতে শায়েস্তা খান যখন সুবাহদার হিসেবে দায়িত্ব নেন, তিনি দীর্ঘ ১০ বছর ঢাকায় অবস্থান করেও দুর্গের কাজ শেষ করেননি।

কারণ, ১৬৮৪ সালে তাঁর কন্যা বিবি পরী এই দুর্গেই মারা যান। শায়েস্তা খান মনে করেন দুর্গটি অশুভ—‘অপয়া’। তাই তিনি এর নির্মাণ কাজ একেবারেই বন্ধ করে দেন।

এই অসমাপ্ততার মাঝেই লালবাগ দুর্গ হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক স্তব্ধ অধ্যায়।

পরিবিবির সমাধি: শোকের স্থাপত্য

দুর্গে প্রবেশ করতেই যেই স্থাপনাটি আপনার চোখে পড়বে সেটিই মূলত পরিবিবির সমাধিসৌধ।

ইতিহাসে যাঁকে ‘বিবি পরী’ নামে চেনা যায়, তিনি ছিলেন সুবাহদার শায়েস্তা খানের কন্যা। মাত্র কৈশোরে, এই দুর্গের ভেতরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।

পরিবিবির এই অকালমৃত্যু লালবাগ দুর্গের নির্মাণে একটি মোড় এনে দেয়। শায়েস্তা খান দুর্গটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি অশুভ—অপয়া। আর সেই মুহূর্ত থেকেই এই প্রাসাদ-দুর্গ পরিণত হয় এক অসমাপ্ত ইতিহাসে।

সমাধিটি স্থাপত্যগত দিক থেকে একটি নিখুঁত মুঘল নিদর্শন। বর্গাকৃতির মূল কাঠামোর মাঝখানে একটি উঁচু চত্বরের ওপর রয়েছে মূল কবরটি, সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত।

চারপাশে রয়েছে খিলানযুক্ত প্রশস্ত বারান্দা। উপরে রয়েছে একটি বড় গোলাকার গম্বুজ, যা ভেতর থেকে অলংকরণে পরিপূর্ণ। সমাধির ভেতরের পরিবেশ শান্ত, স্থির—এবং গভীর এক বিষাদের ছোঁয়া যেন সবসময় মিশে থাকে।

বাইরে থেকে এটি হয়তো সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায়—এই স্থাপনায় শোক আর যত্ন কীভাবে স্থাপত্যে পরিণত হয়েছে।

পরিবিবির সমাধি, আজও, লালবাগ দুর্গের সবচেয়ে সংরক্ষিত এবং সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় স্থান।

হাম্মামখানা: রাজকীয় বিলাসের নিদর্শন

এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি লালবাগ দুর্গের এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থাপনার সামনে—হাম্মামখানা

‘হাম্মাম’ শব্দের অর্থ রাজকীয় স্নানাগার বা বাথহাউজ। মুঘল আমলে এটি শুধু স্নানের জায়গা ছিল না—বরং ছিল বিশ্রাম, বিলাস, আর মাঝে মাঝে চিকিৎসার স্থানও। সুবাহদারদের মতো অভিজাতদের জন্য এটি ছিল দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

লালবাগ দুর্গের এই হাম্মামখানা একটি জটিল কাঠামো। বাইরে থেকে এটি হয়তো একতলা ভবন মনে হবে, কিন্তু এর নিচেই রয়েছে রহস্যে ঘেরা একটি ভূগর্ভস্থ স্নানাগার ব্যবস্থা।

ভবনটির মূল কক্ষগুলোর ভেতর আছে তিনটি আলাদা চেম্বার—একটি ঠাণ্ডা পানির, একটি গরম পানির, এবং একটি গরম বাতাসের জন্য।

এখানে ব্যবহৃত হয়েছিল একটি অত্যাধুনিক হিটিং সিস্টেম—মাটির নিচে সুচারুভাবে বসানো ছিল ফায়ার চেম্বার আর পাইপলাইন, যার মাধ্যমে গরম পানি এবং বাষ্প ছড়িয়ে পড়তো পুরো কাঠামোতে।

এই ব্যবস্থা শুধু শারীরিক আরাম নয়—বরং পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার এক আধুনিক ব্যবস্থা ছিল সেই সময়ের জন্য।

অভ্যন্তরের দেয়াল ও মেঝেতে প্রাচীনকালের চুন-সুরকির ছাপ স্পষ্ট। আলোক প্রবাহের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল উপরের দিকে ছোট ছোট ছিদ্র। এর ফলে দিনের আলো খুব সুন্দরভাবে ভেতরে প্রবেশ করত, কিন্তু বাইরের দৃষ্টিকে ঠেকিয়ে রাখত।

এই হাম্মামখানাটি শুধু রাজকীয় বিলাসের স্মারক নয়, বরং মুঘল স্থাপত্যের প্রকৌশলগত উৎকর্ষতার একটি দুর্লভ নিদর্শন

এখনও গবেষকরা বিস্মিত হন—কীভাবে সেই সময়ে এত নিখুঁত এবং কার্যকর তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছিল।

ছবি : হাম্মামখানার বাহির থেকে

মুঘল কামান: প্রতিরক্ষার প্রতীক

হাম্মামখানার ঠিক সামনে রাখা এই কামানটি মুঘল যুগের। লোহার তৈরি এই কামান প্রায় ৮ ফুট লম্বা, এবং এটি মূলত দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ ছিল।

ছবি : মোঘল আমলের কামান

যদিও এটি ব্যবহার হয়েছিল কিনা তার কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই, ধারণা করা হয়—এটি প্রতীকী অস্ত্র হিসেবে এখানে সংরক্ষিত ছিল। আজ এটি লালবাগ দুর্গে মুঘল সামরিক প্রযুক্তির এক নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

দক্ষিণ তোরণ: প্রবেশদ্বারের ইতিহাস

হাম্মামখানা থেকে বের হয়েই আমার চোখ আটকে গেল লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ তোরণে

এই তোরণটি ছিল দুর্গের মূল প্রবেশদ্বার। ১৭শ শতকে, যখন দুর্গটি সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হতো, তখন এখান দিয়েই প্রবেশ করত মুঘল আমলার দল, সামরিক বহর কিংবা আগত অতিথিরা।

তিনটি খিলানসমেত এই তোরণ স্থাপত্যিক দিক থেকে যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। উপরে রয়েছে প্রহরীদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ—সেখানে দাঁড়িয়ে তারা নজর রাখত কে ঢুকছে, কে বের হচ্ছে।

তোরণটির গঠন শক্তপোক্ত ও ভারী—চুন-সুরকির দেয়ালে স্পষ্ট মুঘল স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব। সাদামাটা হলেও, প্রতিটি খিলান আর কর্নারে আছে বিশদ কারুকাজের ইঙ্গিত, যা সময়ের সাথে কিছুটা মুছে গেলেও, ইতিহাসের গম্ভীরতা যেন এখনও বহন করে।

দুর্গ প্রাচীর: সময়ের স্তম্ভ

দক্ষিণ তোরণ পেরিয়ে আমি এবার হাঁটছি লালবাগ দুর্গের প্রাচীন প্রাচীর ঘেঁষে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই প্রাচীরগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়—কেবল নিরাপত্তা নয়, স্থাপত্যেও কতটা যত্ন ছিল মুঘলদের।

ছবি : লালবাগ দুর্গের দক্ষিন তরন

চুন-সুরকি আর ইটের তৈরি এই দেয়ালগুলো একসময় পুরো দুর্গকে ঘিরে রেখেছিল—শক্ত, দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর হয়ে। দেয়ালের উচ্চতা ও প্রস্থ এমনভাবে নির্মিত যেন ভেতরের রাজকীয় ভবনগুলোকে রক্ষা করা যায় বাইরের যেকোনো আক্রমণ থেকে।

হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে ছোট ছোট চাতাল বা প্রহরীদের অবস্থানের স্থান, যেখান থেকে নজরদারি চালানো হতো। এসব দেখতে দেখতে মনে হয়—প্রাচীরগুলো যেন শুধু ইট-সুরকি নয়, বরং ইতিহাসের একেকটি স্তর

তবে এক সময়ের নিস্প্রভ, পাহারাবেষ্টিত এই অঞ্চল আজ অনেকটাই বদলে গেছে। প্রাচীন দেয়ালের পাশে এখন দেখা যায় আধুনিক দালান, দোকানঘর, বসতি—যা দুর্গের ঐতিহাসিক পরিবেশের সঙ্গে কিছুটা বৈপরীত্য তৈরি করেছে।

এই পুরোনো প্রাচীর ঘেঁষে হাঁটলেই বোঝা যায়, ইতিহাস কখনও পুরোনো হয় না—সে কেবল পরিবেশ বদলায়, প্রেক্ষাপট পাল্টায়।

আরও পড়ুন : সাত গম্বুজ মসজিদের ইতিহাস: ৩৪৫ বছরের পুরনো মুঘল স্থাপত্য

মসজিদ ও বাগান: সৌন্দর্য ও সাধনার মিলন

বাইরে থেকে মসজিদের সামনে আসার পথে, আমি দেখলাম মসজিদের চারপাশে ছোট ছোট বাগান ও ফুলের গাছপালা সজ্জিত। এখানে বিভিন্ন রঙের ফুলের শোভা যেন শীতল ছায়ার মতো পরিবেশ তৈরি করেছে। এই বাগান মূলত দুর্গের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং এটি দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য শান্তিপূর্ণ স্থান হিসেবে কাজ করে।

লালবাগ দুর্গের মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা, যা সুচিত্র কারুকাজ ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর ধনতিতে নির্মিত। মসজিদের মূল গম্বুজটি মাঝখানে এবং দুই পাশে ছোট দুইটি গম্বুজ, যা মসজিদের সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখে। অন্যদিকে এর নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে সাদা সুরকির কাজ, যা মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। মসজিদের সামনের প্রাচীর ও গম্বুজের নিচে সূক্ষ্ম ও জটিল নকশা চোখে পড়ে, যা মুঘল স্থাপত্যের পারদর্শিতার পরিচয় বহন করে।

ছবি : লালবাগ কেল্লা মসজিদ

এই মসজিদ ছিল লালবাগ দুর্গের বাসিন্দাদের নামাজ পড়ার জন্য ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি দুর্গের মধ্যেই অবস্থিত হওয়ায় এর স্থাপত্য ও পরিবেশ থেকে দুর্গের ঐতিহাসিক গম্ভীরতা ও আভিজাত্য পরিস্ফুটিত হয়।

দীঘি ও বিদায়ের মুহূর্ত

লালবাগ কেল্লার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এর বিশাল দক্ষিণ দরজা। এই দরজা দুর্গের প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি আয়তাকার কেল্লার মাঝখানে অবস্থিত এবং মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। দরজাটির চারপাশ ঘিরে শক্তিশালী প্রাচীর, যেখানে কৃত্রিম গম্বুজ, মোড়ানো ফিতকির কারুকাজ এবং খিলান রয়েছে, যা দুর্গের সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। দক্ষিণ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে দর্শনার্থীরা সরাসরি দুর্গের কেন্দ্রস্থল তথা দরবার হল ও পরীবিবির সমাধির দিকে এগিয়ে যেতে পারেন।

দক্ষিণ দরজা থেকে সোজা এগিয়ে গেলে দেখা মেলে লালবাগ দুর্গের দীঘি, যা এখন শুকনো ও পানি শূন্য। একসময় এটি দুর্গের জলাশয় হিসেবে ব্যবহার হত, তবে বর্তমানে এখানে কোনো পানি নেই।

এরপর কিছুক্ষণ বাগানের মাঝে হাঁটাহাটি করতে করতে নামাজের সময় হয়ে গেল। লালবাগ দুর্গের মসজিদে জোহরের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে আমার আজকের এই যাত্রা শেষ হলো।

শেষ কথা

সবকিছু মিলিয়ে আজকের এই ভ্রমণ আমার কাছে ছিল শুধু ইতিহাস দেখা নয়, বরং সেই ইতিহাসের স্তব্ধ, নিঃশব্দ চিহ্নগুলো ছুঁয়ে দেখার এক অভিজ্ঞতা।
লালবাগ দুর্গ শুধু ইট আর সুরকির এক গাঁথুনি নয়—
এটা একটা অসমাপ্ত গল্প, যা আজও সময়ের গায়ে লেখা রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *