বাংলা সালতানাত : যখন বাংলা ছিল স্বাধীন ও স্বশাসিত

আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আপনি কি কখনও ভেবেছেন— কেন আমাদের প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের পেছনে দিল্লির ছায়া ঘোরাফেরা করে? কেন এক দেশ সীমান্তে আমাদের নাগরিককে গুলি করেও দায় স্বীকার করে না? কেন একচেটিয়াভাবে তিস্তা, গঙ্গা, ফেনী—সব নদীর পানি আটকে রাখা হয়, আর আমরা শুধু চুপচাপ দেখে যাই?

আজ যদি কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করে— “আপনি কি সত্যিই স্বাধীন?” তখন বুক ফুলিয়ে বলার মতো কোনো ইতিহাস আপনার জানা আছে?

একটা ইতিহাস যেটা প্রমাণ করে— বাংলা কখনও কারো গোলাম ছিল না আর হবেও না। এই বাংলার বুকে একদিন গড়ে উঠেছিল এক গর্বিত মুসলিম সালতানাত— বাংলা সালতানাত। যেখানে আমরা কারো অনুমতি নিয়ে রাজ্য গড়িনি। বরং যারা আমাদের শাসন করতে চেয়েছে, তাদের চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম— “এই বাংলা, বাংলা থাকবে। দিল্লির না, কারো না।”

একটি জাতির আত্মপরিচয়ের গল্প

আজ আপনি জানবেন সেই ইতিহাস, যেটা শুধু রাজনীতির কথা না— এটা একটা জাতির আত্মপরিচয়ের গল্প।

১৩৪২ সাল। তখন উপমহাদেশে চলছে তুঘলক বংশের রাজত্ব। তাদের ক্ষমতা দুর্বল, প্রশাসন ছিন্নভিন্ন। এই সুযোগে বাংলার গভর্নর শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ঘোষণা দেন— “বাংলা আর দিল্লির অধীনে থাকবে না। বাংলা হবে স্বাধীন।” তিনি শুধু বিদ্রোহ করেননি, তিনি তৈরি করেছিলেন বাংলা সালতানাত— একটি স্বাধীন, শক্তিশালী রাষ্ট্র।

রাজধানী গৌড়, ভাষা বাংলা ও ফারসি, নিজস্ব সেনাবাহিনী, মুদ্রা, বিচারব্যবস্থা—সব আলাদা। তিনি গৌড়, সাতগাঁও, সোনারগাঁও—এই তিন অঞ্চল একত্র করে প্রথমবারের মতো ‘বাংলা’ নামে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজ্য গড়ে তোলেন।

‘সুলতান-ই-বাংলা’ ও সাংস্কৃতিক জাগরণ

ইলিয়াস শাহ শুধু যুদ্ধ জেতেননি, তিনি বাংলার ভেতরেই সৃষ্টি করেন এক সাংস্কৃতিক জাগরণ। নিজ নামে মুদ্রা চালু করেন, যেখানে লেখা থাকত— “আল-সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, সুলতান-ই-বাংলা”। এই প্রথমবার ‘বাংলা’ শব্দটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হয়। তিনি ছিলেন ধর্মীয়ভাবে সহনশীল। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই তাঁর শাসনে ছিল নিরাপদ।

গৌড়ের উত্থান ও সালতানাতের উত্তরাধিকার

তাঁর পরে তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ ও বংশধরেরা সেই রাজত্ব টিকিয়ে রাখেন বহু বছর। বাংলা সালতানাতের সময় গড়ে ওঠে এক আধুনিক নগর—গৌড়। ইতিহাসবিদরা বলেন— গৌড় একসময় লন্ডন বা কায়রোর চেয়েও বড় শহর ছিল।

এই সময় নির্মিত হয়:

ছবি : আদিনা মসজিদ,মালদা

Read More : সাত গম্বুজ মসজিদের ইতিহাস: ৩৪৫ বছরের পুরনো মুঘল স্থাপত্য

দিল্লি বনাম বাংলা

দিল্লির সুলতানরা বহুবার চেষ্টা করেছিল বাংলাকে পুনরায় দখল করতে। তারা বুঝতে পারছিল—বাংলা শুধু শক্তিশালী হচ্ছে না, বরং রূপ নিচ্ছে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তায়। কিন্তু বাংলার সুলতানরা সব আক্রমণ প্রতিহত করেন।

আসাম, আরাকান, আরব বিশ্বে গড়ে ওঠে বাণিজ্য। বহির্বিশ্বে পরিচিতি পায়— “Sultanate Of Bangla” নামে।

পতনের শুরু: বিভাজন ও মুঘল আগমন

১৪৯০ সালের পর, বিভিন্ন বংশের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। এক সময় হাবশি সৈন্যরা ক্ষমতা দখল করে। এই ভেতরের বিভাজন বাংলাকে দুর্বল করে তোলে। ১৫৭৬ সালে, মুঘল সেনাপতি মান সিংহ বাংলা দখল করেন। সালতানাতের সূর্য তখন অস্ত যায়। তবে বাংলা কখনো মাথা নত করেনি। মুঘলদের বিরুদ্ধেও বারবার বিদ্রোহ হয়েছে।

ব্রিটিশ আগমন ও নতুন সংগ্রামের শুরু

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে, বাংলা হারায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা, কিন্তু আত্মমর্যাদা হারায় না। বাংলার সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে যায়— নীল বিদ্রোহ, কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনের মতো সংগ্রামে। বাংলা কখনো মুখ বুজে সহ্য করেনি।

১৯৪৭ সালে, আমরা এক বিভক্তির শিকার হই। পূর্ব বাংলা হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। ধর্মের নামে গঠিত সেই পাকিস্তান— আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অধিকার—কোনো কিছুই গুরুত্ব পায়নি। উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়, অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করা হয়।

তখন বাঙালিরা আবার বলেছিল— “আমরা বাঙালি, আমাদের ভাষা থাকবে বাংলা।” ১৯৫২ সাল, ১৯৭১— সবই ছিল সেই আত্মমর্যাদার উত্তরণ। আমরা শুধু শাসক পালটাইনি— আমরা ইতিহাসের ধারা বদলে দিয়েছি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর: আমরা কোথায়?

আজ, স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরেও— আমাদের পররাষ্ট্রনীতি যেন এখনো দিল্লির অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে।

  • তিস্তা পানি চুক্তি আজও হয়নি
  • সীমান্তে হত্যা, গরু পাচার, আর দ্বিমুখী নীতি
  • ব্যবসা-বাণিজ্যে একতরফা সুবিধা
  • বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ভারতীয় দখলদারিতা

তাহলে প্রশ্ন— আমরা কি সত্যিই স্বাধীন?

না কি আমরা এক “বিনা-ঘোষণায় উপনিবেশ”? এই প্রশ্নই আমাদের ইতিহাসচর্চাকে জরুরি করে তোলে। আপনি যদি বাংলাদেশি হন, তাহলে এই ইতিহাস—আপনার অস্তিত্ব। আপনি সেই জাতির উত্তরসূরি— যারা বারবার শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আপনি সেই বাঙালি— যে নিজের শিকড় জানে, আর জানে— গোলামি আমাদের জন্য নয়।

আমাদের পূর্বপুরুষরা গড়েছিলেন বাংলা সালতানাত— নিজের নামে, নিজের অধিকার নিয়ে। আজও যদি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান— তাহলে এই ইতিহাস ভুলে যাবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *