বাংলাদেশের আকাশে ‘ফ্লায়িং কফিন’
ভারতের আকাশে যখন ফ্রান্সের অত্যাধুনিক চতুর্থ প্রজন্মের রাফাল যুদ্ধবিমান ছুটে চলছে, চীন যখন পঞ্চম প্রজন্মের J-২০ দিয়ে মহড়া চালাচ্ছে, আর তুরস্ক পঞ্চম প্রজন্মের নিজস্ব প্রযুক্তির ‘KAAN’ যুদ্ধবিমান তৈরি করে বিশ্ববাজারে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে— তখন আমাদের দেশের আকাশ পাহারা দিচ্ছে ৬০-এর দশকের F-৭ এর মতো পুরনো, ‘ফ্লায়িং কফিন’ নামে কুখ্যাতি কুড়ানো সেই যুদ্ধবিমান।
আমরা কি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি?
প্রশ্ন জাগে— আমরা কি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি? আবার অনেকে মনে করে এক অজানা রাজনৈতিক বলয় চায় না আমরা নিজেদের বিমান বাহিনির সক্ষমতা বাড়াই! আজকের এই আলোচনায় আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করব। বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী বিমান বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের বিমানবাহিনী তুলনা করব, আর ভবিষ্যতে আমাদের বিমান বাহিনীকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে— সেটাও আলোচনা করব।
আধুনিক যুদ্ধের মূলে বিমান বাহিনী
বর্তমানে পৃথিবীর যুদ্ধ আর ক্ষমতার লড়াইয়ে, বিমান বাহিনী আধুনিক রণকৌশলের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো এই ক্ষমতা গড়তে হাজারো কোটি ডলারের বিনিয়োগ আর অবিরাম গবেষণা চালাচ্ছে। আমেরিকা, যাদের এয়ার ফোর্সকে বলা হয় ‘দ্য ফার্স্ট স্ট্রাইক ফোর্স’, তাদের ফ্লাইট তালিকায় রয়েছে ফিফথ জেনারেশন ফাইটার, যেমন F-২২ Raptor আর F-৩৫ Lightning II। এই বিমানগুলো শুধু আকাশেই আধিপত্য বিস্তার করে না, সাইবার যুদ্ধ থেকে শুরু করে স্টিলথ প্রযুক্তিতে বিস্ময় জাগায়। বিশ্বের নানা দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতি এই বিমানগুলোর কৌশলগত গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
রাশিয়া, তুরস্ক ও দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক শক্তি
রাশিয়া তাদের Su-৩০, Su-৩৫, আর পঞ্চম প্রজন্মের Su-৫৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তাদের যুদ্ধকৌশল ‘আসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার’ এবং ‘ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার’-এর উপর নির্ভরশীল, যা আধুনিক যুদ্ধের নতুন রূপ। তুরস্ক, সামরিক প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এখন এক নতুন উচ্চতায়। ‘KAAN’ এর মতো পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করে তারা শুধু নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে না, বিশ্ববাজারে তাদের অবস্থানও জোরালো করছে। তাদের Bayraktar TB2 ড্রোনগুলো আধুনিক যুদ্ধের রূপই পাল্টে দিয়েছে।
ভারত, চীন ও পাকিস্তান: আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে ভারত, চীন এবং পাকিস্তান তাদের বিমান বাহিনী আধুনিকীকরণে দারুণ অগ্রসর। ভারতের ফ্লিটে রয়েছে রাফাল, Su-৩০, মিগ-২৯, দেশীয় Tejas এবং ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হচ্ছে পঞ্চম প্রজন্মের AMCA। চীন ইতিমধ্যেই J-20 এর মতো স্টিলথ ফাইটার প্রস্তুত করে ফেলেছে, আর বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি করছে J-10C ও JF-17 এর মতো বিমান। তারা মহড়ার মাধ্যমে যুদ্ধ দক্ষতা বাড়াচ্ছে এবং ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বে শীর্ষে উঠতে চায়। পাকিস্তানও J-10 ও JF-17 থান্ডার দিয়ে নিজেদের আকাশ সুরক্ষায় প্রস্তুত, এবং কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
বাংলাদেশের বিমানবাহিনী ও বাস্তবতা: সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা
‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’— এই শ্লোগান নিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় থেকেই সাহসিকতার নিদর্শন দেখিয়েছে এই বাহিনী। সাধারণ মানুষের অগাধ ভালোবাসা আর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মনিয়োগের প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বিমান বাহিনী। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত, বিমান বাহিনী যতই চেষ্টা করুক না কেন, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব এবং বাজেটের সীমাবদ্ধতায় আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পরিচালনা করছে প্রায় ২১৬টি বিমান, যার মধ্যে যুদ্ধবিমান হিসেবে প্রধানত রয়েছে F-৭ এবং মিগ-২৯। F-৭ যুদ্ধবিমান ১৯৬০-এর দশকে চীনে তৈরি, যা এখন প্রযুক্তিগতভাবে একেবারে পুরনো। এদের দুর্ঘটনার হার এত বেশি যে বিশ্বে এগুলোকে ‘ফ্লায়িং কফিন’ নামে ডাকা হয়। অন্যদিকে, মিগ-২৯ রাশিয়ান যুদ্ধবিমান হলেও তা রাফাল, J-10C, বা Su-৩৫ এর সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো নয়।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের জন্য J-10C যুদ্ধবিমান কেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়?
কেন পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের বিমানবাহিনী আধুনিকায়নে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ তিনটি— অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতীয় ঐকমত্যের অভাব। প্রথমত, যুদ্ধবিমান কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন বিশাল বাজেট, যা বাংলাদেশের সামরিক বরাদ্দে সম্ভব হয় না। ২০২৫ সালের বাজেটে সামরিক খাতে বরাদ্দ হতে পারে মাত্র ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং স্বল্প সদিচ্ছা। জাতীয় স্বার্থের বদলে দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থমকে যায়। তৃতীয়ত, প্রতিবেশী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র ও বাধা উপেক্ষা করে চলার জন্য দরকার রাজনৈতিক ঐক্য— যা এখনও স্পষ্টভাবে গড়ে ওঠেনি।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
প্রযুক্তির এই যুগে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা মানে দেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। প্রতিবেশীরা যখন আধুনিক বিমানবাহিনী গড়ে তুলছে, তখন আমরা এখনও পুরনো যুদ্ধবিমান দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। এই ধীরতা শুধু সামরিক সক্ষমতার জন্য নয়, সার্বভৌমত্বের জন্যও বড় হুমকি।
একটি শক্তিশালী বিমান বাহিনী মানে শুধু আকাশে ডানা মেলা নয়, এটি দেশের মর্যাদা, গর্ব আর নিরাপত্তার প্রতীক। এখন সময় এসেছে আমাদের আকাশকেও সত্যিকার অর্থে মুক্ত করার।