দ্রুজ সম্প্রদায় কারা, কেন সিরিয়ায় ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে?

নেতানিয়াহুর দাবির আড়ালে বাস্তবতা কী?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু টেলিভিশনে দাঁড়িয়ে বলছেন— ‘আমরা দ্রুজ জনগণকে রক্ষা করছি।’ ঠিক সেই সময় ইসরাইলের যুদ্ধবিমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বোমা ফেলছে। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবন ধ্বংস করা সহ, অসহায় বেসামরিকদের মৃত্যু, আর দ্রুজ অধ্যুষিত সুইদা প্রদেশে দগ্ধ হচ্ছে শত শত মানুষ। সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতনের পর এমন সংঘর্ষ এটাই প্রথম। প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি ইসরায়েল দ্রুজদের রক্ষা করছে? নাকি এটা তাদের সামরিক আগ্রাসনের নতুন এক কৌশল— যেখানে সিরিয়ায় ধর্ম, রাজনীতি আর ভূখণ্ডের খেলা শুরু করে দ্রুজ সম্প্রদায়কে সামনে ঠেলে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে ইসরাইল? আর এই দ্রুজ সম্প্রদায় কারা, কেন সিরিয়ায় ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে?

ভিডিওতে দেখুন: বাস্তব চিত্র ও প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা সহ পুরো ঘটনাটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই ভিডিওতে

সুইদা থেকে উত্তেজনা: সংঘাতের শুরু

১৩ জুলাই, সিরিয়ার সুইদা প্রদেশ। সেখানে একজন দ্রুজ ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে একদল সুন্নি বেদুইন গোষ্ঠী। এখান থেকেই মূলত এই নতুন সংঘাতের সূচনা। প্রতিশোধের জন্য নামতে শুরু করে স্থানীয় দ্রুজ মিলিশিয়ারা। উত্তেজনা ছড়ায় দ্রুজ ও সিরিয়ার আরব বেদুইনদের মাঝে, কিন্তু বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। ঠিক এর দুদিন পর— ১৫ জুলাই, ইসরায়েল সামরিক হস্তক্ষেপ করে। তাদের ভাষ্য: “আমরা দ্রুজ সংখ্যালঘুদের রক্ষা করছি।” কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে— মাত্র ৪ দিনে সেখানে নিহত হয়েছে ৩৫০ জন। ৬ দিনে এই সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়, যার মধ্যে অনেক নারী-শিশুও রয়েছে।

নতুন সরকার, পুরনো বিভাজন

এদিকে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারাহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও, সিরিয়ার অভ্যন্তরীন বিষয়ে ইসরাইলের এই আগ্রাসনের ফলে পরিস্থিতি এখন আরও ঘলাটে আর ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। ইসরায়েল কি সত্যিই দ্রুজদের রক্ষা করছে? বিশ্লেষকরা বলছেন— ইসরাইল মূলত সিরিয়ার ভেতর নতুন এক ‘বাফার জোন‘ তৈরি করে, গোলান হাইটসের নিরাপত্তার নামে নতুন ভূখণ্ডের দখলে মনোযোগী। দ্রুজদের ‘বন্ধু’ দাবি করে সিরিয়ার নতুন সরকারকে ব্যর্থ করাই ইসরাইলের আসল উদ্দেশ্য।

দ্রুজ সম্প্রদায়: ইতিহাস ও গোপন বিশ্বাস

এই জটিল পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে— এই দ্রুজ সম্প্রদায় আসলে কারা? দ্রুজ সম্প্রদায়ের ইতিহাস অনেক পুরনো, আর অনেকটাই রহস্যময়। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর উৎপত্তি ১১শ শতকে, ফাতেমীয় খলিফা আল হাকিমের সময়। ইসলাম ধর্মের ইসমাইলি শিয়া মতবাদ থেকে উৎস হলেও, দ্রুজ ধর্মের মধ্যে রয়েছে— গোপন দর্শন, আত্মা পুনর্জন্মের বিশ্বাস। তাদের ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে ‘রাসায়েল আল-হিকমাহ’— যেটি অন্য ধর্মের কারো পড়া তো দূরের কথা, ছুঁয়েও দেখাও নিষেধ। তাদের মধ্যে ধর্মান্তর নিষিদ্ধ— জন্মসূত্রেই হতে হয় দ্রুজ। তারা নিজেদের পরিচয় দেয়: ‘আল-মুয়াহহিদিন’— একত্ববাদী। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ১০ লাখের মতো দ্রুজ আছেন— তার মধ্যে বড় অংশ সিরিয়ার দক্ষিণে—সুইদা অঞ্চলে বাস করে। এছাড়াও লেবানন, জর্ডান ও ইসরায়েলে তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে।

সিরিয়ার নতুন নেতা আহমদ আল-শারাহ এবং ইসলামপন্থি আশঙ্কা

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটে। এরপর ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তী সরকার, যার প্রধান হন— আহমদ আল-শারা। তিনি এক সময় আল-কায়েদার সিরীয় শাখা জাবহাত আল-নুসরা’র সদস্য ছিলেন। একসময় আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট এই নেতা এখন রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলতে চাচ্ছেন নতুনভাবে। তাঁর ঘোষিত লক্ষ্য: “গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সিরিয়া পুনর্গঠন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার।” শারা বলছেন— ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়েও সিরিয়ার ভেতরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই এখন তার মূল লক্ষ্য।

ইসরায়েলের ভূখণ্ড পরিকল্পনা ও সামরিক কৌশল

কিন্তু, ইসরায়েল সিরিয়ার এই অভ্যন্তরীন অস্থিরতাকে নতুন সুযোগ হিসেবে দেখছে। আর এদিকে দ্রুজদের মধ্যে সিরিয়ার এই নতুন নেতৃত্বের প্রতি দ্বিধা রয়েছে। তারা মনে করে— ইসলামপন্থি এই সরকার ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ইসরায়েল মনে করে, সিরিয়ার নতুন সরকার ইসলামপন্থী। তাদের দৃষ্টিতে এটি একটি ‘সন্ত্রাসী-ঘেঁষা’ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য উত্থান। তাই, সিরিয়ার অভ্যন্তরীন দুর্বলতা ও অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে— একদিকে সামরিক হামলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ‘রক্ষার’ নাটক সাজিয়ে তারা তৈরি করছে এক নতুন কৌশল— সিরিয়ার অভ্যন্তরে জোটভিত্তিক বিভাজন। ইসরায়েলি সামরিক প্রধান বলছেন— “আমরা দক্ষিণ সিরিয়াকে সন্ত্রাসের ঘাঁটি হতে দেব না।” প্রশ্ন হলো— এই রকম আগ্রাসী কৌশল কি সিরিয়ার শান্তি ফেরাবে? নাকি দেশটিকে আবার এক গৃহযুদ্ধের মুখে ঠেলে দেবে?

গোলান হাইটস: একটি দখলদারি ইতিহাস

ইসরায়েল বহুদিন ধরেই সিরিয়ার গোলান হাইটসকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে— যদিও তা আন্তর্জাতিকভাবে সিরিয়ার অংশ হিসেবেই স্বীকৃত। ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসন গোলান হাইটসকে ইসরায়েলের অংশ বলে স্বীকৃতি দিলে তা পরিস্থিতিকে আরও উসকে দেয়। আর এখন, ইসরায়েল সুইদা অঞ্চলে দ্রুজদের ‘রক্ষা’র নামে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে— তাদের আরেকটি নতুন দখলদারি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন— ইসরায়েল এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষকে ব্যবহার করছে একটি নতুন ‘বাফার জোন’ বানানোর জন্য— যেখানে দ্রুজদের ব্যবহার করা হচ্ছে মানবঢাল হিসেবে। একদিকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে প্রভাব, অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহকেও দূরে রাখা— এই দ্বিমুখী লক্ষ্যই তাদের সাম্প্রতিক বোমা বর্ষণের পেছনে যুক্তি হতে পারে।

দ্রুজ সমাজে মতভেদ এবং বিভাজনের রাজনীতি

আবার দ্রুজ সম্প্রদায়ের ভিতরেও বিভক্তি স্পষ্ট। সিরিয়ায় অনেক দ্রুজ সরকারপন্থী, কিন্তু বেশিরভাগই নিরপেক্ষ বা বিরোধীপন্থী। ইসরায়েল ও লেবাননের দ্রুজরা আবার ভিন্ন অবস্থান নেয়। লেবাননের প্রভাবশালী দ্রুজ নেতা ওয়ালিদ জুমব্লাত সরাসরি ইসরায়েলের আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছেন। অন্যদিকে, ইসরায়েলের ভিতর থাকা কিছু দ্রুজ নেতা ইসরাইলের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি ইসরাইলের অভ্যন্তরীন অনেক দ্রুজ ইসরাইলের সেনাবাহিনীতেও কর্মরত। এই বিভাজনকেই হাতিয়ার বানিয়ে ইসরাইল খেলছে সেই পুরোনো খেলা— “Divide and Control” —বিভাজন সৃষ্টি করো, তারপর তা ব্যবহার করো নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিতে।

বন্ধুত্ব না স্বার্থপরতা?

প্রশ্নটা এখন আর শুধু একটি অপহরণ বা সংঘর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রশ্নটা এখন— সিরিয়ার নিজেদের ভূখণ্ড রক্ষা নিয়ে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অস্ত্র বানানো নিয়ে, আর যুদ্ধের ‘অজুহাত’ দিয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালানোর বৈধতা নিয়ে। ইসরায়েল কি দ্রুজদের বন্ধু, না শত্রু? সিরিয়া কি আসলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এই চাপের মধ্যেও?

Read More : চীনের রহস্যময় HQ-9B প্রতিরক্ষা সিস্টেম পেল ইরান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *