বাংলাদেশের একতা কি আদিকাল থেকেই ছিল?
আজকের এই বাংলাদেশ কি শুরু থেকেই এতটা একত্রিত, এতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল? ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট—এই বিশাল অঞ্চলগুলো কীভাবে এক হলো? কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জাগেনি?
এই বিশাল বাংলাকে প্রথমবারের মতো একসূত্রে বেঁধে, ‘বাংলা’ নামক একত্রিত ভূখণ্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যিনি—তাঁর নাম কি আপনি জানেন?
বাংলা জাতীয়তাবাদের রূপকার: শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
আজ আমরা সেই ব্যক্তির কথা জানব, যিনি জন্মগতভাবে বাংলার সন্তান না হয়েও, বীরত্ব, দূরদর্শিতা আর ঐক্যের মাধ্যমে এমন এক ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যার কারণে তিনি আজকের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন—বলছিলাম সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কথা।
মধ্যযুগের বাংলার সুলতানী শাসনামলের কথা উঠলেই প্রথমেই স্মরণে আসে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের নাম। তিনি শুধু বাংলার সিংহাসনে আরোহনকারী একজন সাধারন সুলতান নন, বরং বাংলার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের বীজ বপনের রূপকার হিসেবেও পরিচিত।

ইলিয়াস শাহের উৎস, আগমন ও প্রাথমিক জীবন
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সাল থেকে ১৩৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলাকে শাসন করেন। যদিও তাঁর পূর্বপুরুষ্দের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না, তবে জানা গেছে তিনি পূর্ব পারস্যের বর্তমান ইরানের সিজিস্তান শহরের এক সম্ভান্ত্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার জন্মনাম ছিল ইলিয়াস শাহ। বাংলার সিংহাসনে আরোহন করার পর তিনি নিজেকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নামে ঘোষণা করেন।
ইলিয়াস শাহ কখন এবং কিভাবে ভারতবর্ষে আসেন, তার সমকালীন কোনো সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন সলিম তাঁর গ্রন্থ “রিয়াজউস—সালাতীন” এ উল্লেখ করেছেন যে, ইলিয়াস শাহ ও তাঁর এক দুধভাই আলী মুবারক একসময় দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলকের সেবক ছিলেন। ধারণা করা হয় একটি নারীঘটিত কারনে ফিরোজ শাহ ক্ষীপ্ত হয়েছিলেন ইলিয়াস শাহের উপর। বিপদের আঁচ আগে থেকে পেয়ে হাজী ইলিয়াস জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান দিল্লি থেকে। ফিরোজ শাহ তাঁকে ধরে আনার জন্য ইলিয়াস শাহের ভাই আলী মুবারককে আদেশ দেন। কিন্তু আলী মুবারক হাজী ইলিয়াসকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর আলী মুবারক বাংলায় চলে আসেন এবং লখনৌতির শাসক কদর খানের অধীনে চাকরি পান। অল্পকিছুনের মধ্যেই আলী মুবারক কদর খানের আস্থাভাজন হন এবং প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। পরে এক যুদ্ধে কদর খান নিহত হলে আলী মুবারক ‘সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ’ উপাধি নিয়ে লখনৌতির সিংহাসনে বসেন।
আরো পড়ুন : বাংলা সালতানাত : যখন বাংলা ছিল স্বাধীন ও স্বশাসিত
বিদ্রোহ, সিংহাসন দখল ও একক বাংলা প্রতিষ্ঠা
ভাই আলী মুবারক লখনৌতির শাসক হলে ইলিয়াস শাহ দিল্লি থেকে লখনৌতি অর্থাৎ বাংলা অঞ্চলে চলে আসেন, কিন্তু আলী মুবারক তাঁকে বন্দি করেন। তাঁর মায়ের অনেক অনুরোধে পরে আলী মুবারক ইলিয়াসকে মুক্ত করে উচ্চ পদে নিয়োগ করেন। ইলিয়াস শাহ ছিলেন যোগ্য সমরকুশলীে এক সেনাপতি। তিনি সুযোগ বুঝে তার ভাই লখনৌতির আলাউদ্দিন আলী শাহের বিরুদ্ধেই একসময় বিদ্রোহ ঘোষনা করে যুদ্ধ শুরু করেন এবং জয়লাভ করে ১৩৪২ সালে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহন করেন।
সেই সময়ে দিল্লিতে তুঘলক বংশের শাসন চলছিল, যার প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দীন তুঘলক ১৩২০ থেকে ১৩২৫ সাল পর্যন্ত দিল্লি শাসন করেন। তিনি বাংলায় দিল্লির আধিপত্য কায়েম করে বাংলাকে তিন প্রদেশে ভাগ করেছিলেন—লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও বা সপ্তগ্রাম, এবং সোনারগাঁও। আর ইলিয়াস শাহের শাসন অঞ্চল লখনৌতি ছিল এই তিন অঞ্চলের একটি অর্থাৎ সাতগাও বা সপ্তগ্রামের অংশ।
তিনটি অঞ্চলেই আলাদা রাজধানী ও শাসক ছিলেন, যারা দিল্লির অধীনস্ত থাকলেও নিজেদের মধ্যে বিরোধ সংঘাতে লিপ্ত ছিল প্রতিনিয়ত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইলিয়াস শাহ তিন প্রদেশ জয় করে পুরো বাংলাকে একীভূত করেন এবং ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ উপাধি গ্রহণ করেন। এই নামেই বাংলা প্রথম ‘বাঙ্গলা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাই বাংলার ঐতিহ্যের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করে।
সামরিক সাফল্য, দিল্লির আক্রমণ প্রতিহত ও প্রশাসনিক দক্ষতা
শুল্ক, আইন-শৃঙ্খলা ও ক্ষমতার সংহতকরণ করে ইলিয়াস শাহ স্বাধীনভাবে বাংলায় রাজত্ব শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি এবং রাজ্যের বিস্তার ও স্থিতিশীলতা ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। বাংলার পাশাপাশি তিনি বাংলার বাইরে বিহারেও সফল অভিযান পরিচালনা করেন। বিহারে জয়লাভের পর তিনি নেপাল জয় করেন ১৩৪৬ সালে। কাঠমুন্ডু শহরে জয়রাজ দেবকে পরাস্ত করে তিনি নেপাল জয় করেন। এছাড়া তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হন, যদিও উড়িষ্যা পুরোপুরি দখল করতে পারেননি।
ইলিয়াস শাহের এই উজ্জ্বল সাফল্যের কারণে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ঈর্ষান্বিত হন। তাছাড়া ইলিয়াস শাহের প্রতি তার আগের সেই ক্ষোভ তো আছেই। ১৩৫৩ সালে তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলায় অভিযানে আসেন ইলিয়াস শাহকে দমন করতে। ইলিয়াস শাহ সুরক্ষিত একডালা দূর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ পান্ডুয়া দখল করে দূর্গ আক্রমণের প্রস্তুতি নেন, কিন্তু বহু চেষ্টা সত্ত্বেও দূর্গটি দখল করতে ব্যর্থ হন। ১৩৫৪ সালে শেষমেষ দুপক্ষের মধ্যে সন্ধি হয় এবং ফিরোজ শাহ দিল্লিতে ফিরে যান।

ঐক্যের রূপকার হিসেবে চিরস্মরণীয়
সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কৃতিত্ব ছিল অপরিসীম। বুদ্ধি, শৌর্য, নেতৃত্ব ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে তিনি সামান্য আঞ্চলিক শাসক থেকে বাংলা দেশকে একত্রিত করে এই অঞ্চলের একক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন—যা একটি বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ ও খুবই জনপ্রিয়, এবং তাঁর শাসনামলে বাংলায় শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করত। তাঁর সুশাসনে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মধ্যে প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন গড়ে ওঠে।
দূরদর্শী শাসক হিসেবে ইলিয়াস শাহ ফিরোজ শাহের আক্রমণের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান মুসলমান। ফকির ও দরবেশদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অসীম। পীর আখি সিরাজউদ্দিন ও তাঁর শিষ্য শায়খ আলাউল হক, শায়খ রাজা বিয়াবানী এদেশে এসে ইলিয়াস শাহের দরবার অলংকৃত করেন। তিনি তাঁদের সম্মানে খানকাহ, মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বাংলা সুলতানাতের প্রতিষ্ঠাতা
অনেকে মনে করেন তিনি মঠ বা মন্দির ভাঙচুর করতেন, কিন্তু এমন কোনও প্রামান্য তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। নিজের শাসনঅঞ্চলে থাকা কোনও বিধর্মীদের উপাসনালয়েও তিনি ক্ষতি করেননি। বরং তিনিই এই অঞ্চলের হিন্দুদের নিজের রাজসভার গুরুত্তপূর্ন পদে আসীন করেছিলেন।
যদিও সুলতানী আমল শুরু করেন ফখরুদ্দিন মুবারাক শাহ, তবুও সুলতানি যুগের যোগ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকেই গণ্য করা হয়। তিনি বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছন।, কারণ তিনিই প্রথম বাংলাকে একত্রিত করে একটি স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন, এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন।